ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক ইবোলার প্রকোপটি আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে দুই বছর আগে এই মরণঘাতি ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল।
২৭ এপ্রিলের পর থেকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, যেখানে কয়েক ডজন সশস্ত্র গোষ্ঠী অবস্থান করে সেখানে এই রোগের নতুন কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
২০১৮ সালের আগস্টে প্রথমবার এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৩৩৯০ জন লোক প্রাণ হারিয়েছেন এই মরণঘাতি রোগে।
এই ভাইরাসের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক প্রকোপটি ছিল পশ্চিম আফ্রিকাতে যেখানে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এগারো হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শেষ হয়েছে যেখানে নিরাপত্তাহীনতাও বিস্তৃত আকারের। এটা উদযাপন করার মতই সুখবর কেননা গত দুই বছর ধরে অনেক কঠিন ও ভয়ঙ্কর ভাবে এই রোগের সাথে লড়াই চলে আসছিল।
তবে, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, যা আকারে পশ্চিম ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের সমান, দেশটির উত্তর-পশ্চিমে একটি নতুন ইবোলা প্রাদুর্ভাব নিয়ে কাজ করছে।
কঙ্গোর এমবান্দাকায় জুনের এক তারিখ প্রথম শনাক্তের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল যেখানে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভাইরাসটির জেনেটিক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এটি পূর্ব থেকে পাওয়া ভাইরাসের একটি আলাদা স্ট্রেন।
কঙ্গোতে কাজ করা ডব্লিউএইচও বিবিসিকে জানিয়েছে, দেশের একাদশতম প্রকোপ – এমবান্দাকায় পরিস্থিতি এখন প্রায় নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কঙ্গোর বহু অংশে বিভিন্ন প্রাণীতে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সেই প্রেক্ষিতে নতুন ইবোলা প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কোনো ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সমাপ্ত ঘোষনার জন্য শেষ সংক্রমিত বা আক্রান্ত ব্যক্তির পরীক্ষায় নেগেটিভ ফলাফল আসার পর অন্তত ৪২ দিন অতিবাহিত হতে হয়।
কেনো এত দেরি হলো?
পূর্ব গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো-তে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ১৯৭৬ সালের পর থেকে দেশটিতে দশম তম ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছিল।
যখন এই ভাইরাসটি প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল তখন এই ভাইরাসটিকে আবিষ্কার করা বিজ্ঞানীরা এটিকে একটি স্থানীয় নদীর নামে নামকরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এভাবেই এর নাম হয়েছিল ইবোলা ।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী এটেনি লংগান্ডো এটিকে ডিআর কঙ্গোর ইতিহাসের “দীর্ঘতম, সবচেয়ে জটিল এবং মারাত্মক” প্রাদুর্ভাব হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
যুগের পর যুগ ধরে ঘটে আসা সংঘর্ষ গুলোর ফলে কর্তৃপক্ষের প্রতি দেশের মানুষের বিস্তর অবিশ্বাস বাড়ে, যা স্বাস্থ্যকর্মীদের অসুস্থ ও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের চিকিত্সা করা আরও কঠিন করে তুলেছিল।
আরো পড়ুনঃ তানজানিয়ায় ১৫ কেজি ওজনের দুটি বিরল তানজানাইট পাথর পেয়ে রাতারাতি লাখপতি এক খনি খননকারী
বিবিসির এক স্বাস্থ্য প্রতিবেদনে জানা গেছে ২০১৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী দ্বারা এই অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলিতে ৪২০ টিরও বেশি হামলা হয়েছে, যা এই রোগের বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
দেশটির পুর্বাঞ্চলে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনার আরেকটা বাঁধা ছিল এই অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান। এটি প্রায় ১২০০ কিলোমিটার (৪৭৬ মাইল) জুড়ে বিস্তৃত এক ভূখণ্ড যেখানে তিনটি প্রদেশ রয়েছে; উত্তর কিভু, ইতুরি এবং দক্ষিণ কিভু।
আক্রান্ত রোগীদের ভয়ঙ্কর সব লক্ষণে ভোগার কারণে সবার মাঝে এই মারাত্মক ইবোলা ভাইরাসের ভয়, চিরাচরিত দাফন রীতি নিষিদ্ধ করে স্বাস্থবিধি মোতাবেক দাফন করাও ছিল তাদের ভয়ের কারণ। যার ফলে কেও নিজেদের মধ্যে এই রোগ দেখা দিলেও প্রকাশ করতে চাইতেন না। এটাও একটা বড় বাঁধা ছিল বলে মনে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
কিভাবে এই অর্জন সম্ভব হলো?
আফ্রিকাইয় কর্মরত ডাব্লুএইচওর আঞ্চলিক পরিচালক বলেছেন, সকলের সহযোগিতার কারণেই এই প্রাদুর্ভাবের সমাপ্তি ঘটানো সম্ভব হয়েছে।
ডাক্তার মাতশিদিসো ময়েটি বলেছেন, “এটি আশা জাগানোর বিষয় যে, সংহতি এবং বিজ্ঞান দ্বারা মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।”
সর্বকালের বৃহত্তম ইবোলা ভ্যাকসিন প্রচারণা এর ভাইরাসের বিস্তারকে রুখে দেয়ার এক অন্যতম কারণ ছিল।
দুইটি পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন প্রায় ৩ লক্ষ ২০ হাজার জনকে প্রদান করা হয়েছিল।
স্বাস্থ্য কর্মীরা এবং কঙ্গোর কর্তৃপক্ষের কঠোর প্রচেষ্টা ভাইরাসটিকে প্রতিবেশি দেশগুলোতে ছড়ানো প্রতিরোধে সফলতা দেখিয়েছে।
প্রতিবেশি দেশ উগান্ডায় গতবছর ডিআর কঙ্গোর সীমান্ত পার করে নিজেদের পরিবারের সাথে দেখা করে যাবার পর পাঁচ বছরের এক ছেলে এবং তার দাদি মারা গিয়েছিল।
কয়েক মাস পরে, ডাব্লুএইচও কর্তৃক সমালোচনার মুখে পড়েছিল তানজানিয়া। কারণ তারা এক ব্যক্তির মৃত্যু সহ সন্দেহজনক ইবোলা সংক্রমণের তথ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
- ইবোলা একটি ভাইরাস যা প্রাথমিকভাবে হঠাৎ জ্বর, তীব্র দুর্বলতা, পেশী ব্যথা এবং গলা ব্যথা সৃষ্টি করে
- এটি বমি বমিভাব, ডায়রিয়া এবং উভয় অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক রক্তক্ষরণে অগ্রসর হয়
- ইবোলা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত, বমি, মল বা শারীরিক তরল দিয়ে ভাঙা ত্বক বা মুখ এবং নাকের মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ করার সময় লোকেরা সংক্রামিত হয়
- ডিহাইড্রেশন এবং একাধিক অঙ্গ ব্যর্থতা থেকে রোগীদের মৃত্যু হয়।
আরো পড়ুনঃ কৃষ্ণাঙ্গ বিজ্ঞানী ‘হিডেন ফিগার’ ম্যারি ডাব্লিউ জ্যাকসনের নামে নাসার সদরদপ্তরের নামকরণ করা হয়েছে